অনিয়ম আর দুর্নীতির আখড়া ডায়াগনিস্টিক সেন্টারগুলো: জবাবদিহিতা কার কাছে?

0
দুর্নীতিতে সরকারের জিরো টলারেন্স ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি নজর আসে মিডিয়ার। তারই অংশ হিসেবে কিছুদিন আগ পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালগুলোর অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনার খবর গণমাধ্যমে চাউর হয়েছিলো। এখন সেটা কিছুটা থিতিয়ে এসেছে, কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে ওইসব সংবাদে জেলা এবং উপজেলা হাসপাতালগুলো নিয়ে মিডিয়া যতটা সরগরম হয়েছিলো, ততখানি দৃষ্টি পড়েনি বেসরকারি হাসপাতাল এবং ডায়াগনিস্টিক সেন্টারগুলোর ওপর। অথচ এইসব ডায়াগনিস্টিক সেন্টারগুলোর অনিয়ম এবং দুর্নীতি অনেক বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিকেও হার মানাচ্ছে। একজন রোগীর সঠিক চিকিৎসার আগে প্রয়োজন হয় সঠিক রোগ নিরুপনের। কিন্তু সেটা যদি সঠিক না হয়, তাহলে ঘটে ভুল চিকিৎসা এবং এতে করে রোগ ভালো হওয়ার পরিবর্তে দেখা দেয় নানান পার্শ্বপ্রতিক্রীয়া, যা একজনকে রোগিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশে চিকিৎসায় ঘাপলা আছে বলেই এদেশের মানুষ বিদেশে পাড়ি জমায় এবং রাষ্ট্র থেকে অনেক মুদ্রা বিদেশের কোষাগারে গিয়ে জমা হয়।  এদেশে ভালো চিকিৎসক আছে, আছে বিশ্বমানের মেডিসিন। কিন্তু ডায়াগনিস্টিক সেন্টারগুলোর ভুল রোগ নিরুপনের জন্যে সমগ্র সিস্টেমটাই আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। ভুল ডায়াগনোসিসের কারণেই গ্যাসট্রিকের রোগী হার্টের অষুদ খায়, হার্টের রোগী খায় গ্যাস্ট্রিকের অষুদ। ফোঁড়ার রোগিকে দেয়া হয় ক্যান্সারের অষুদ, হাঁড়ভাঙ্গা রোগি পায় বাতের অষুদ। সেই সাথে কতো জাতের অষুদ লিখে ডাক্তাররা প্রেসকিপশন ভরিয়ে তুলছেন সে কথা সবাই জানে। চিকিৎসা সেবার নামে এসকল প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে, যেন দেখার কেউ নেই। মূলতঃ এসব প্রতিষ্ঠানকে নজরদারি করার জন্যে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, কিন্তু চোরে চোরে মাসতুতু ভাই প্রবাদটা এখানে কার্যকর হওয়ার ফলে কাজের কাজ কিছু হচ্ছেনা বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আজ জেলা শহর পঞ্চগড়ের একটি ডায়াগনিস্টিক সেন্টারের চিত্র পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চাই, প্রায় তিরিশ বছর ধরে কীভাবে এরা রোগ নিরুপনের নামে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছে। প্রতিষ্ঠানে নাম সনো ল্যাব। এটির অবস্থান পঞ্চগড় তেতুলিয়া সড়কের পাশে। প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাতুন নাহার, যিনি পঞ্চগড়ের মির্জা গোলাম হাফিজ ডিগ্রী কলেজ এর সহকারি শিক্ষক। তাঁর স্বামী ডা. বাহারাম আলী, যিনি একসময় একটি সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত এবং সোনো ল্যাবেই নিয়মিত বসেন। বাহরাম আলীর চিকিৎসা সনদ জাল বলে শোনা যায় এবং তিনি একজন তৃতীয় শ্রেণীর চিকিৎসক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু স্ত্রীর প্রতিষ্ঠানে তিনি অন্যতম চিকিৎসক বলে রোগীরা তার কাছে আসতে বাধ্য। ডা. বাহরামের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ তিনি বিভিন্ন অষুদ কোম্পানীর কাছ থেকে মাসিক এবং বাৎসরিকভাবে কয়েক লক্ষ্ টাকা উৎকোচ নিয়ে থাকেন এবং প্রেসক্রিপশনে প্রয়োজন থাকুক আর না থাকুক ওইসব অষুদ লিখে থাকেন। এছাড়াও প্রয়োজন না হলেও নিজেদের ডায়াগনিস্টিক সেন্টারের বিভিন্ন পরীক্ষা করিয়ে রোগিদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। এই প্রতিষ্ঠানটিতে সাধারণতঃ সরকারের শ্রম আইন মানা হয়না। এখানে নূন্যতম বেতনে কিছু কর্মচারি কাজ করে যারা সাপ্তাহিক কোনো ছুটি পাননা, সরকারি ছুটিরতো প্রশ্নই আসেনা। এছাড়াও প্রতিদিন ১০ ঘন্টারও অধিক কাজ করতে হয় কিন্তু তাদেরকে কোনো ওভারটাইম দেওয়া হয়না। ঈদ পুজোয় কর্মচারিরা বোনাসটুকুও পাননা। অথচ ঢাকায় জিন্নাতুন নাহারের দুটি ফ্ল্যাট বাড়ি ছাড়াও ল্যাবের পাশেই সাত তলা বাড়ি করেছেন এবং ব্যাংকে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকা ছাড়াও অন্যান্য সম্পদ বাগিয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানটিতে আরও তিনজন পরিচালক থাকলেও বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত তিনি একাই নিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। সামান্য কারণে কর্মচারিদের ছাটাই এখানে নিত্য নৈমিত্যিক ঘটনা এবং এক্ষেত্রে পরিচালনা পরিষদের সাথে বৈঠক সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা থাকলেও তিনি একাই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। প্রতিষ্ঠানটিতে কর ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। তেমনি ল্যাবে সরকার স্বীকৃত কোনো টেকনিশিয়ান নেই। এছাড়াও মেয়াদ উত্তীর্ণ কেমিক্যাল ব্যবহার করে রোগিদের প্রতিনিয়তঃ প্রতারণা করা হচ্ছে। রোগীদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহের জন্যে আলাদা সুঁচ ও সিরিঞ্জ ব্যবহারের কথা থাকলেও একই সুঁচ ও সিরিঞ্জ দিয়ে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে রক্তের নমূণা সংগ্রহ ও হাতে গ্লাবস ব্যবহার না করার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে এই ল্যাবটির বিরুদ্ধে। জিন্নাতুন নাহার একটি কলেজের চলমান দায়িত্বে থাকা অবস্থায় সেখানে ক্লাস না নিয়ে বেতন নিচ্ছেন এবং সারাদিন ল্যাবেই তার সময় কাটে। সারাদেশে দুদকের এতো দাপট অথচ পঞ্চগড় জেলা দুর্নীতি দমন অফিস সোনো ল্যাবের মতো প্রতিষ্ঠান দ্যাখেনা, দেশে শ্রম আইন আছে অথচ পঞ্চগড়ে খুব সম্ভবত শ্রম অধিদপ্তর কিংবা শ্রম আদালত বলতে কিছু নেই, এখানে কোনো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিংবা জেলা সিভিল সার্জন অফিস আছে বলেও মনে হয়না। পঞ্চগড়ে সরকারের রাজস্ব অফিস নেই বলেই হয়তোবা সোনো ল্যাবের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো কর ফাঁকি দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। কোনো এক বিচিত্র কারণে পঞ্চগড়ের প্রশাসন, র‌্যাব পুলিশও কোনো ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করেননা, অপরদিকে জেলা শিক্ষা অফিস কিংবা শিক্ষা অধিদপ্তর নেই বলেইতো বোধ করি জিন্নাতুন নাহার একই সাথে কলেজের শিক্ষক আবার একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খুলে বসে জনসাধারণে সাথে নিয়তঃ প্রতারণা করে সম্পদের পাহাড় গড়ছেন।
Share.

Comments are closed.