খুলনা মহানগরী থেকে সড়কপথে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের কোলঘেঁষে কয়রা উপজেলা। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ ২৯টি। তবে কর্মরত আছেন মাত্র সাতজন। ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের ২২টি পদ শূন্য। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নগরজীবনের অনেক সুযোগ-সুবিধা না থাকায় এ উপজেলায় যেতে চান না বেশিরভাগ চিকিৎসক। আর পদায়নকৃত সাত চিকিৎসকের মধ্যে চারজনই মাসের অধিকাংশ সময় কর্মস্থলে থাকেন না। পাইকগাছা ও তেরখাদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দুই চিকিৎসককেও হাসপাতালে পাওয়া যায় না। বেতন নিতেই কর্মস্থলে আসেন তারা। এ ছাড়া জেলার চিকিৎসকদের ৬২ শতাংশ পদ শূন্য রয়েছে। গত ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি এবং ১০ ফেব্রুয়ারি সরেজমিন এসব তথ্য পাওয়া যায়।
কয়রা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অভিযোগ, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (মেডিসিন) ডা. ফারজানা কবীর, সহকারী সার্জন ডা. কিশোর কুমার শীল ও ডা. ইশতিয়াক মাহমুদকে বেশিরভাগ দিনই হাসপাতালে পাওয়া যায় না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাদের কেউ ২০১৬, কেউবা ২০১৭ সালে এখানে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকেই তারা অনিয়মিত। একই অভিযোগ থাকলেও তিন দিন আগে মেডিকেল অফিসার ডা. রাকিবুল হাসান অন্যত্র বদলি হয়ে গেছেন। ডেন্টাল সার্জন ডা. আফিয়া সুলতানা এক বছরেরও বেশি সময় ছুটিতে রয়েছেন। তিনি ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে এ পর্যন্ত কর্মস্থলে যাননি। তিনি বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন বলে হাসপাতালের একাধিক কর্মচারী জানান। তবে কর্মস্থলের কেউ তার মোবাইল নম্বরও দিতে পারেননি। এ ছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. সুজাত আহমেদ খুলনা শহরে থাকায় তিনিও হাসপাতালে অনিয়মিত।
খুলনা সিভিল সার্জন ডা. এ এস এম আবদুর রাজ্জাক গত ২৭ জানুয়ারি কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, ওই চিকিৎসকদের কর্মস্থলে পাওয়া যায়নি। তাদের শোকজ করা হয়েছে। এ ছাড়া কয়রা ইউএইচএফপিওর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে। এর আগেও তাকে সতর্ক করা হয়েছে। পরে শোকজ করা হয়েছে। তিনি শোকজের জবাব না দিয়ে আমার বিরুদ্ধে চিকিৎসক নেতাদের কাছে নালিশ করে বেড়াচ্ছেন। তবে অনিয়মের ব্যাপারে তাকে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না।
হাসপাতালে বিভিন্ন অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. সুজাত আহমেদ ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘এ বিষয় দেখার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগে অনেক লোক রয়েছে। আমি আপনাদের কাছে জবাবদিহি করতে রাজি নই।’
কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ২শ’ রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন। এ ছাড়া গড়ে ৬০ জন ভর্তি রোগীর চিকিৎসা দিতে হয়। চিকিৎসক সংকটের কারণে হাসপাতালের ভর্তি রোগীদের নিয়মিত দেখভাল করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহির্বিভাগে আসা রোগীদের অধিকাংশেরই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে গ্রাম্য ডাক্তার অথবা বেসরকারি ক্লিনিকে যেতে হয় রোগীদের।
গত ২৯ জানুয়ারি সকালে হাসপাতালে আসা উপজেলার জয়পুর গ্রামের শেফালি খাতুন বলেন, নারীদের শারীরিক অনেক উপসর্গ থাকে, যা পুরুষ ডাক্তারকে বলা যায় না। এখানে কোনো নারী ডাক্তার নেই, তাই ফিরে যাচ্ছি।
হাঁটুর ব্যথার চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন কালনা গ্রামের গফুর হাওলাদার। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়, শহরে গিয়ে ভালো অর্থোপেডিক ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার জন্য। তিনিও চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিভিল সার্জনের দপ্তর, ৯টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, তিনটি ডিসপেনসারি, দুটি ক্লিনিক ও দুটি হাসপাতালে চিকিৎসকের মোট পদ রয়েছে ৩২০টি। এর মধ্যে মাত্র ১১৯ জন চিকিৎসক কর্মরত। বাকি ২০১টি পদই শূন্য রয়েছে, যা শতকরা ৬২ শতাংশ। এর মধ্যে খুলনার একমাত্র বক্ষব্যাধি ক্লিনিকে একজন চিকিৎসকও নেই।
অভিযোগ রয়েছে, অনেক চিকিৎসক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে চান না। তারা তদবির করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি ঠেকান। আবার বদলি করা হলেও তদবির করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে জেলা সদরে চলে যান।
এদিকে, পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. মিয়া মমতাজ দৌলত আলম ও তেরখাদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. নুসরাত নাহিয়ান দীর্ঘদিন ধরে কর্মস্থলে অনুপস্থিত। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানান সিভিল সার্জন। তিনি আরও বলেন, সব অভিযোগ সঠিক নয়। ২-৩ মাসের মধ্যে শূন্য থাকা অনেক পদ পূরণ হবে। এ ছাড়া পদায়নকৃত চিকিৎসকরা যাতে ঠিকমতো কর্মস্থলে থাকেন, সে বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটর করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, খুলনা জেনারেল হাসপাতাল, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট থাকলেও চিকিৎসক অনুপস্থিতির অভিযোগ নেই।
পাইকগাছা ও তেরখাদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার আসেন শুধু বেতন নিতে
0
Share.