লস অ্যাঞ্জেলস থেকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন

0

মো: শফিকুল আলম

আমেরিকা যাচ্ছেন- আমরা ধরেই নিয়ে থাকি তিনি নিউইয়র্ক যাচ্ছেন। বেশির ভাগের ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটে থাকে। আমেরিকা ভ্রমণের কথা উঠলে সবার আগে নিউইয়র্ক চলে আসে। কিন্তু অনেকেই যে লাইনটা ধরে থাকেন আমি সেদিকে না গিয়ে হেঁটেছি ভিন্ন পথে। পরিকল্পনা করলাম লস অ্যাঞ্জেলেস হয়ে অ্যারিজোনায় যাবো গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখতে।

এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন নিয়ে ডিসকভারিতে ডকুমেন্টারি দেখেছি। তাই এটা দেখার প্রবল আগ্রহ জন্মালো মনে। ভ্রমণযাত্রী আমি একাই। যাওয়ার আগে ইন্টারনেট ঘাটতে শুরু করলাম। খুঁজে পেলাম লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে অ্যারিজোনায় গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের অনেক প্যাকেজ ট্যুর রয়েছে। তবে যেতে হবে লাস ভেগাস হয়ে। আমেরিকার এই বিখ্যাত জায়গাটাও দেখার সুযোগ হয়ে যাচ্ছে। লাস ভেগাস দেখবো বলে নিজেকে যেন আরেকটু ভাগ্যবান মনে হলো।

আমি যে ওয়েবসাইট থেকে সব কনফার্ম করেছি তার ওয়েব অ্যাড্রেস হচ্ছে www.taketours.com. খুবই ভালো ওয়েবসাইট মনে হয়েছে আমার কাছে। তুলনামূলক অন্যগুলোর চেয়েও সস্তা। আমার ট্যুরটা ছিল তিন দিন লাস ভেগাস, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ট্যুর লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে। সিঙ্গেল গেলে খরচ পড়বে বেশি। দু’জনের জন্য প্যাকেজ কিনলে আরেক জনের জন্য ফ্রি পাওয়া যায়। আমি যেহেতু সিঙ্গেল আমার এই প্যাকেজের মূল্য পড়লো ১৭৯ ডলার। সাথে আরেকজন হলে আমার নিজের এই প্যাকেজের মূল্য দাঁড়াতো ৯৯ ডলার। হোটেল আর সব ট্রান্সপোর্টের খরচ ওদের। খাওয়ার খরচ ছিল আমার নিজের।

প্রথম দিন আমার যাত্রা লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে লাস ভেগাস। দূরত্ব ২২৮ মাইল। বাসে উঠে দেখলাম পুরো প্রক্রিয়াটিই নিয়ন্ত্রণ করছে চাইনিজরা। বুঝতে বাকি রইলো না চাইনিজরা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে আছে। অবশ্য বেশির ভাগ ট্যুরিস্ট ছিল চাইনিজ। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বেশ ক’জন ট্যুরিস্টকে পেয়েছিলাম। ফ্রান্স থেকে এক মেয়ে তার বাবা-মাকে নিয়ে ঘুরতে এসেছে।

লস অ্যাঞ্জেলস থেকে লাস ভেগাস যাওয়ার পথে সবচেয়ে বেশি মনে ধরেছে ডেথ ভ্যালি বা মৃত্যু উপত্যকা। এই ডেথ ভ্যালির কথা অনেক পড়েছি এবং শুনেছি। সমগ্র উপত্যকাটি বালুতে পরিপূর্ণ। প্রতিবছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটক আসে এই ডেথ ভ্যালি দেখার জন্য। এবার নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য হলো। ডেথ ভ্যালির মাঝ দিয়ে রাস্তা। মনে হচ্ছিল কোন ছবির মধ্যে আছি। ইংলিশ অনেক মুভিতে এরকম দৃশ্য দেখেছি। লাস ভেগাস যাওয়ার পথে মাঝে বিরতি দেয়া হল সেখানে দুনিয়ার সব বিখ্যাত ব্র্যান্ডের দোকান পেয়ে গেলাম এক ছাদের নিচে। প্রায় সব আউটলেটেই ডিসকাউন্ট ছিল।

লাস ভেগাস যখন পৌঁছালাম তখন বিকাল হয়ে গেছে। চারদিকে পাহাড়। এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক শহর। বৃহৎ সব অট্টালিকা। হোটেল পৌঁছার পর গাইড যার যার রুম বুঝিয়ে দিলো। আমরা উঠলাম লাস ভেগাসের বিশাল এক হোটেলে। এর নাম স্ট্রাটোসফিয়ার। লাস ভেগাসের সবচেয়ে উঁচু হোটেল এটি। অবশ্য এর ১১৫০ ফিট উচ্চতার টাওয়ারের কারণে।

থাকার হোটেল ২৪ তলা। এর বিশালতা এতোটাই যে রুম সংখ্যা দুই হজার চার’শ ২৭টি। এর রয়েছে বিশাল এক ক্যাসিনো। ৮০ হাজার বর্গফুটের এই ক্যাসিনোতে এক প্রান্ত খেকে আরেক প্রান্তে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। লাস ভেগাসের প্রায় প্রতিটি হোটেলের নিচেই বিশাল বিশাল সব ক্যাসিনো। বাসে থাকার সময়ই গাইড জানিয়েছিল চাইলে রাতের লাস ভেগাস দেখার সুযোগ আছে। এজন্য আলাদা ২০ ডলার করে দিতে হবে। লাস ভেগাস এসেছি। আর রাতের লাস ভেগাস দেখবো না। তা কি হয়। হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রাতের লাস ভেগাস দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম।

গাইড বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেলো আর বিভিন্ন স্থাপনা নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে লাগলো। রাতের লাস ভেগাস অন্যরকম এক জগৎ। আলোর যে কতো রকমের খেলা হতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। সারা দুনিয়ার পর্যটকদের আকর্ষণ রাতের লাস ভেগাস। সারা দিন বাস জার্নির পর আবার রাতের লাস ভেগাস দেখতে দেখতে শরীর অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়লো। হোটেলে যখন ফিরলাম শরীর আর সায় দিলো না। গাইড জানিয়ে দিয়েছিলো খুব সকালে উঠতে হবে।

পরদিন আমাদের যাত্রা গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। বেছে নিতে হবে সাউথ রিম অথবা ওয়েস্ট রিম। সাউথ রিম অনেক দূরে। ওয়েস্ট রিম তুলনামূলক কাছে। আমি বেছে নিলাম সাউথ রিমকেই। লাস ভেগাস থেকে এর দূরত্ব ২৭৫ মাইল। মোবাইলে অ্যালার্ম বাজার আগেই ঘুম ভেঙে গেল। ঝটপট রেডি হয়ে নিচে গিয়ে দেখি ভোরের আলো ফুটতে তখনও কিছুটা সময় বাকি। আমাদের ট্যুরের একটা গ্রুপ চলে যাবে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের ওয়েস্ট রিমে। আর আমরা যাবো সাউথ রিমে। দূরত্ব কম হওয়ার কারণে ওয়েস্ট রিমে যাওয়া দলে পর্যটকের সংখ্যা ছিল বেশি। আর বেশি দূরত্বের কারণে আমাদের দলটা ছোট হয়ে পড়লো।

গাড়ি ছুটলো লাস ভেগাস থেকে সাউথ রিমের দিকে। গাড়ি ছুটছে তো ছুটছেই পথ আর ফুরোয় না। লম্বা জার্নির পর আমরা পৌঁছে গেলাম অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্কে। মোবাইলে কোন নেটওয়ার্ক নেই। গাইড জানিয়ে দিলো কোন রাস্তা দিয়ে ঘুরে আবার কিভাবে ফিরে আসতে হবে। সময় বেঁধে দেওয়া হলো। মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই বলে গাইডের পক্ষে কাউকে ফোন করে ডেকে আনাও সম্ভব না। হাঁটা শুরু করলাম।

যখন গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের কাছে এসে পৌঁছালাম বিশ্বাসই যেন হচ্ছিল না। বিস্ময়ে শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো। এই সেই বিখ্যাত গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। ডিসকভারী চ্যানেলে বহুবার এর ডকুমেন্টারি দেখেছি। আজ আমি নিজে এর সামনে দাঁড়িয়ে। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন হচ্ছে বিশাল এক গিরিখাত। এর দৈর্ঘ্য ২৭৭ মাইল। আর গভীরতা ১ মাইলেরও বেশি। এই গিরিখাতের মধ্য দিয়ে কলোরাডো নদী বয়ে গেছে। ১৭ মিলিয়ন বছর আগে কলোরাডো নদী এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া শুরু করেছে। কলোরাডো নদী তার প্রবাহ আর ভূমিক্ষয়ের মাধ্যমে আজকের এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে রূপ নিয়েছে।

প্রতি বছর ৫০ লাখের মতো মানুষ আসে এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখতে। পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক বিস্ময় হচ্ছে এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া থেকে বাস্তবের জগতে ফিরলাম যখন মোবাইলে দেখলাম এবার যাওয়ার সময় হয়েছে।

গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন থেকে লাস ভেগাসের পথে মাঝে আমাদের গন্তব্য নেভাডা অঙ্গরাজ্যের হোভার ড্যাম। একটি ড্যাম যে কতোটা পর্যটক টানতে পারে সেখানে না গেলে তা বিশ্বাস করা হতো না। ১৯৩১ সালে এর নির্মান কাজ শুরু হয়ে এটি চালু হয় ১৯৩৬ সালে। উপর থেকে বিস্ময়ের চোখে হোভার ড্যাম দেখলাম আর ছবি তুললাম। হোভার ড্যাম পর্ব শেষ করতে করতে সন্ধ্যা নেমে এলো।

রাতে ক্লান্ত শরীরের যখন হোটেলে ফিরলাম বিছানায় শরীর হেলিয়ে দিয়েই ভাবতে শুরু করলাম পৃথিবী কতোটা বৈচিত্র্যময় আর রহস্যে ঘেরা।

Share.

Comments are closed.